মিয়ানমারে নিধন, নির্যাতন ও নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের এখানেও করুণদশা চলছে। প্রতিদিন ত্রাণের জন্য সংগ্রাম আর তাঁবুর জায়গা খুঁজতে এখনো ব্যস্ত হাজারো রোহিঙ্গা।
রাতে চোখে ঘুম নেই, পেটে ক্ষুধার যন্ত্রণা নিয়ে অসহায় অবস্থায় রয়েছেন নতুন করে আসা প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা। নিবন্ধিত ক্যাম্পের বাইরে থাকা পুরনো পাঁচ লাখ রোহিঙ্গার নেই কোনো কর্মসংস্থান। বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে দেওয়া ত্রাণ সহায়তার পরিমাণও কমে এসেছে।
সময়মতো এনজিও ব্যুরোর পক্ষ থেকে এনজিও প্রতিষ্ঠানের টাকা ছাড় ও কাজের অনুমোদন দিচ্ছে না বলে খাদ্য সংকট এখন চরমে। সরকার উখিয়ার কুতুপালং এবং বালুখালীর তিন হাজার একর জায়গা রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দ দিলেও আবাসন সংকট নিরসন হয়নি।
সব মিলিয়ে এখানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের করুণ অবস্থা চলছে। তবে হাজারো অভাব-অনটন থাকলেও এখানে প্রাণে বেঁচে থাকার যে নিশ্চয়তা রয়েছে, তাতেই অনেকটা স্বস্তি বোধ করছেন রোহিঙ্গারা। সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত আসা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৬ লাখ।
কিন্তু বেসরকারি আরও বিভিন্ন সংস্থা এবং পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দেওয়া তথ্যমতে, এ সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে। এর আগে অতীতে বিভিন্ন সময় কক্সবাজারসহ দেশের নানা স্থানে আশ্রয় নিয়েছে আরও প্রায় সাড়ে ৫ লাখ রোহিঙ্গা। এদের মধ্যে মাত্র ৩০ হাজার রোহিঙ্গা উখিয়ার কুতুপালং ও টেকনাফের লেদার আশ্রয় ক্যাম্পে শরণার্থী স্বীকৃতি নিয়ে বসবাস করছে।
এই ৩০ হাজার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী প্রতি মাসে পেয়ে এলেও বাকি বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা নিয়মমাফিক ত্রাণের আওতায় আসেনি। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর, আইওএম এবং ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম শরণার্থী স্বীকৃতিপ্রাপ্তদের মধ্যে এই মাসিক ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করে থাকে।
একই সঙ্গে তাদের জন্য চিকিৎসা ও ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। পাশাপাশি অনিবন্ধিত নতুন রোহিঙ্গাদের জন্য এ ধরনের সংস্থাগুলো ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে এলেও তা অনিয়মিত এবং প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে রোহিঙ্গাদের বিশাল একটি অংশ দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের নিশ্চয়তা পায়নি এখনো।
এ ছাড়া বড় একটি অংশ কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই না পেয়ে এখনো ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। আর যারাও বা তাঁবু খাটানোর জায়গা পেয়েছে, এর অধিকাংশই ঝুঁকিপূর্ণ। কক্সবাজারের শতাধিক বালুময় পাহাড়ি বনভূমিতে তাঁবু খাটানোর ফলে রয়েছে ভূমিধসের আশঙ্কা।
আবার বৃষ্টি হলেই তাঁবুর নিচে জমে থাকা পানিতে মেঝেগুলো হয়ে যাচ্ছে কাদাময়। তাই অধিকাংশ রোহিঙ্গার চোখে ঘুম নেই। পেটে ক্ষুধার তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে তাদের। পাশাপাশি অনেক রোহিঙ্গা নারী-শিশু ও বৃদ্ধ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে বেঁচে থাকার জন্য খেয়ে না খেয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
সরকারি উদ্যোগে সাতটি ও বেসরকারি উদ্যোগে আরও অন্তত ১০টি মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করা হলেও রোগীর তুলনায় তা অনেক কম। অন্যদিকে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থায় এখনো স্বাস্থ্য ও পরিবেশসম্মত গতি ফিরে না আসার কারণে ডায়রিয়া, সর্দি-কাশি, জ্বর লেগেই আছে। ইতিমধ্যে হাজার হাজার রোহিঙ্গা শিশুর শরীরে হাম, পোলিও, যক্ষ্মার মতো রোগ বাসা বেঁধেছে।
সরকার রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য হাম ও পোলিওর টিকাদান কর্মসূচি শুরু করেছে। এতে হয়তো তা নিয়ন্ত্রণে আসবে কিন্তু পরিবেশগত কারণে নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ছে বলে জানালেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বরত চিকিৎসকেরা।
এদিকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছে এমন বেশ কয়েকটি এনজিও সংস্থার টাকা ছাড় ও কাজের অনুমোদন প্রক্রিয়া নিয়মের বেড়াজালে আটকে পড়েছে। এতে চার দিন ধরে কমে এসেছে এনজিওদের ত্রাণ সহায়তাও। এত দিন রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণ সহায়তা দিয়ে আসছিল এমন ৩০টির বেশি এনজিও ত্রাণ দিতে পারছে না।
ত্রাণ সহায়তা প্রদানে টাকা ছাড় ও অনুমোদন লাভের জন্য এনজিও ব্যুরোর কাছে এসব সংস্থা আবেদন করলেও গত দুই সপ্তাহে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। ফলে খাদ্যসহ ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে এসব এনজিও এখন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, টাকা ছাড় ও অনুমোদন লাভের ক্ষেত্রে সাধারণত এত দীর্ঘসূত্রতা হয় না। রোহিঙ্গাদের মধ্যে খাদ্য সহায়তা দিয়ে আসা এনজিও হেলপ ফর নিডির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ সুজন খন্দকার ও পাল্স বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘বিদেশি দাতাসংস্থা টাকা দিয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু বর্তমানে সব ধরনের এনজিওর টাকা ছাড় করতে হয় এনজিও ব্যুরোর মাধ্যমে। অতীতে এত জটিলতায় পড়তে হয়নি কোনো সংস্থাকে।
এবার টাকা ছাড়ের জন্য এবং কাজের অনুমোদনে আমাদের বেগ পেতে হচ্ছে। দ্রুত এনজিও ব্যুরোর অনুমোদন না মিললে রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ ও খাদ্য সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করবে। এ ক্ষেত্রে শিগগিরই সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে সচেষ্ট হতে হবে।
এনজিও সংস্থাগুলোর ত্রাণ প্রদানে অনুমোদন না দিলে এ পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেবে বলে জানান এ দুই এনজিও কর্মকর্তা। কুতুপালং ক্যাম্পের ইনচার্জ (যুগ্ম-সচিব) মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘সরকার নতুন আসা রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধনের আওতায় আনছে। নিবন্ধন কার্যক্রম শেষ হলে ত্রাণ সহায়তা, শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে একটা শৃঙ্খলা আসবে। এ সময় সরকারি ত্রাণগুলো বিতরণ করা হলে এ সংকট হয়তো থাকবে না। ’
চোখে ঘুম নেই পেটে ক্ষুধা
Reviewed by BD News
on
অক্টোবর ২২, ২০১৭
Rating:
Reviewed by BD News
on
অক্টোবর ২২, ২০১৭
Rating:

কোন মন্তব্য নেই: