মিয়ানমার সরকারের হত্যা ও নির্যাতন থেকে প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়েই সমাধানের পথে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। একদিকে, যেমন মিয়ানমারকে ঘিরে বিশ্ব রাজনীতির জটিল হিসেবনিকেশ সামাল দিতে হচ্ছে; তেমনি সামর্থ্যরে বাইরে মানবিক বিবেচনায় আশ্রয় দিতে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। এমনকি আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন আদায়েও বেশ সফলতার পরিচয় দিয়েছে দেশটি। পাশাপাশি প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারসহ অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখতেও সমর্থ হয়েছে।
ইতোমধ্যেই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বেশ প্রশংসিত হয়েছে বিভিন্ন মহলে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেওয়া এসব উদ্যোগ বিশ্ব গণমাধ্যমেও প্রশংসিত হচ্ছে। জাতিসংঘ বাংলাদেশের এই অবস্থানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। একইভাবে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র। গত বৃহস্পতিবার দেশটির পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র হিদার নোয়ার্ট বলেন, ‘আমি জানি, অন্য যেকোনো দেশের মতোই, শরণার্থীদের ভার বাংলাদেশকে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেছে।’ নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাই রোহিঙ্গা ইস্যু তুলে ধরে বাংলাদেশের কাছ থেকে পাকিস্তানকে শিক্ষা নিতে বলেছেন। গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ সফরে এসে তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিনে এরদোয়ানও মানবিকতা প্রদর্শনের জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সরকারের সামনে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করছেন দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, রোহিঙ্গা প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থান সময়োচিত ও যথার্থ। তবে এসব উদ্যোগ শেষপর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারকে বর্তমানে ও ভবিষ্যতে বেশকিছু আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। এর মধ্যে কঠিন কাজটি হলো ভারত, চীন ও রাশিয়াসহ বিভিন্ন প্রতিবেশী ও বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রের সমর্থন আদায় করা। এমনকি প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গেও সম্পর্ক নষ্ট করা যাবে না। বিশেষ করে শেষপর্যন্ত আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন নিজেদের পক্ষে রাখাই হবে কঠিন চ্যালেঞ্জ। কেননা স্বার্থের কারণে এসব রাষ্ট্র মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করতে রাজি নয়। পাশাপাশি আশ্রয় দেওয়া রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে রেখে বাসস্থান, খাদ্য ও চিকিৎসাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে বেশ কঠিন। বিশেষ করে আগের ও নতুন আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা যাতে কিছুতেই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে না পারে, সেদিকটা নজর রাখতে হবে বেশি।
এছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের ভেতর রোহিঙ্গাদের জন্য একটি নিরাপত্তা অঞ্চল তৈরি, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করা এবং মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধে আন্তর্জাতিক মহলের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, ভারত ও চীনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র মিয়ানমারের ব্যাপারে তাদের মনোভাব স্পষ্ট করছে না। আবার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে বাংলাদেশ তাদের বিরুদ্ধেও অবস্থান নিতে পারছে না। ফলে বাংলাদেশকে এক কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে কৌশলী পথে এগোতে হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশ সরকারকে এই মুহূর্তে কূটনৈতিক রাজনীতি অব্যাহত রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ দিতে হবে ও রোহিঙ্গা ফেরত নিতে বাধ্য করতে হবে। তবে কিছুতেই বিভিন্ন রাষ্ট্র, এমনকি মিয়ানমারের সঙ্গেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট করা যাবে না বলেও সতর্ক করে দিয়েছেন তারা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বর্তমানে সরকার নানামুখী কার্যক্রম নিয়েছে। গত ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করলে কঠোর অবস্থান নেয় বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি ও স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের চাপ বাড়তে থাকলে শেষ পর্যন্ত মানবিক কারণে আশ্রয় দেওয়ার নিদের্শ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৪ সেপ্টেম্বর সোমবার সন্ধ্যার পর সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী। গণভবনে রাত পৌনে ১০টা পর্যন্ত চলা ওই বৈঠকেই মূলত পরিস্থিতি সতর্কতার সঙ্গে মোকাবেলার সিদ্ধান্ত হয়। এ সময় আগত উদ্বাস্তুদের সঙ্গে ‘অত্যন্ত মানবিক আচরণ’ করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি সরাসরি মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে কূটনৈতিক আলোচনা, এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের সহায়তা পেতে কূটনৈতিক উদ্যোগ, জাতিসংঘ, ইইউ, ওআইসি, আসিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। ঢাকার সব কূটনৈতিক মিশন ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে নিয়মিত ব্রিফিং করা হচ্ছে। বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে নিয়মিত ব্রিফিং নোট পাঠানো হচ্ছে। এ ছাড়া বিবিসি, সিএনএস, আল জাজিরা, গার্ডিয়ানসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের পথ বেশ চ্যালেঞ্জিং ও জটিল। বাংলাদেশ আক্রান্ত। কিন্তু সমস্যা সমাধান বাংলাদেশের হাতে নেই। ফলে বাংলাদেশ উভয় সংকটে পড়েছে। বিশ্ব জুড়ে তোলপাড় চলছে ঠিকই, কিন্তু সমাধান নেই। জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞা প্রকাশ করলেও এখন পর্যন্ত লিখিত নিন্দা প্রকাশ করতে পারেনি। এর আগেও বহুবছর ইস্যুটি পাশ কাটিয়ে গেছে।
এই বিশ্লেষক বলেন, বর্তমান সরকারের আগে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সক্রিয় কোনো পদক্ষেপ ছিল না। বরং সীমান্ত খুলে দিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এখন সরকার একদিকে যেমন প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করছেন, তেমনই আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মহলের মাধ্যমে এই সংকটের সমাধান খুঁজছেন। এটি সঠিক পদক্ষেপ।
‘তবে এমন সময় রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশ তৎপর হলো, যখন সময়টা খুব জটিল’ উল্লেখ করে অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ভারত, চীন ও রাশিয়া, কে কত বেশি মিয়ানমারের পাশে থাকতে পারে, সে প্রতিযোগিতা চলছে। তা না হলে এমন নির্যাতন সত্ত্বেও এসব দেশ চুপ কেন? অর্থাৎ বাংলাদেশের জন্য সময়টা প্রতিকূল। একদিকে মিয়ানমার প্রতিবেশী, অন্যদিকে ভারত, রাশিয়া ও চীনও গুরুত্বপূর্ণ। তারপরও বাংলাদেশ সাহসীকতার সঙ্গে এগোচ্ছে। নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে সাহসী উদ্যোগ নিচ্ছে। এসব তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের জন্য অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জও রয়েছে বলে মনে করেন এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক। তারমতে, আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বাংলাদেশ এখন সতর্ক হচ্ছে—এটা ভালো দিক। যারা চলে এসেছে, তারা যেন বাড়তি কোনো চাপ সৃষ্টি করতে না পারে, সেদিকে নজর রাখতে হবে। কোথায় কত রোহিঙ্গা কিভাবে আছে, সে ব্যাপারে সতর্ক তদারকি থাকতে হবে। সমস্যাটির স্থায়ী সমাধানে তৎপর থাকতে হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বলেন, ইতোমধ্যে বাংলাদেশে আটকে থাকা রোহিঙ্গারা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাগত দিক থেকে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ওপর আরো তিন লাখ রোহিঙ্গার দায়িত্ব নেওয়া নিম্ন-মধ্যম আয়ের একটি দেশের পক্ষে খুবই কঠিন। ইতোমধ্যে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষের কাছে চিঠি পাঠিয়ে বাংলাদেশ জানিয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যেই যাতে একটি ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ তৈরি হয়। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব দেশগুলোর আঞ্চলিক জোট আসিয়ান ও মুসলিম দেশগুলোর সংস্থা ওআইসির সঙ্গে কূটনৈতিক চ্যানেলে এ ব্যাপারে বাংলাদেশ উদ্যোগী হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক উদ্যোগে ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠা হলে সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গারা সেখানেই নিরাপদে থাকতে পারবে। উদ্বাস্তুদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দিলেও কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এই অবস্থান পরিবর্তন করেনি যে, রোহিঙ্গাদের রাখাইনেই ফেরত যেতে হবে। তাদের ভার বাংলাদেশ অনির্দিষ্টকালের জন্য বহন করতে পারবে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও রোহিঙ্গা শরণার্থী গবেষক অধ্যাপক জাকির হোসেন মনে করেন, ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক তাতে দেশ দুটিকে কিছুতেই চটাতে চায় না। উচিতও হবে না। আবার রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে এই দু শ দেশের সমর্থন খুবই জরুরি। পাশাপাশি অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নেওয়ার রোহিঙ্গারা যাতে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে না ওঠে, সেদিকেও সতর্ক থাকতে হবে। রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হলে ভারত, চীন ও রাশিয়াকে লাগবে। কারণ, এদের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক ভালো। একইসঙ্গে বাংলাদেশকে বর্তমান অবস্থান ধরে রাখতে হবে। বিশেষত আন্তর্জাতিক মহল যাতে উদ্বাস্তুদের মানবিক সহায়তায় এগিয়ে আসে ও অব্যাহত রাখে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
রোহিঙ্গা সমস্যা : কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগোচ্ছে বাংলাদেশ
Reviewed by BD News
on
সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৭
Rating:
Reviewed by BD News
on
সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৭
Rating:

কোন মন্তব্য নেই: